মানুষের খাদ্য, পুষ্টি, খনিজ পদার্থ ও ভিটামিনের চাহিদা পূরণ, শারীরিক বাড়তি, মেধার বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, পশু-পাখির খাবার, খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং রফতানি আয় বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সুবিধা আমরা ফল থেকে পেয়ে থাকি। প্রতিদিন এ দেশের প্রতিজন লোকের ফল খাওয়া দরকার ১০০-১১৫ গ্রাম। আর আমরা খাচ্ছি মাত্র ৩৫-৪০ গ্রাম। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকের ও কম। শুধু আমাদের মানসিক দৈন্যতা, অভ্যাস আর পরিকল্পনার অভাবে আমাদের ফলভিত্তিক পুষ্টি দৈন্যতা এতটা প্রকট। পেয়ারাকে অনেকে ‘গরিবের আপেল’ বলে থাকেন। পেয়ারার গুণাগুণ আপেলের থেকে কোন অংশেই কম নয়। পেয়ারাতে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে যা মানবদেহের গঠন ও বৃদ্ধিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পেয়ারার গুণ এখানেই শেষ নয়- শিকড়, গাছের বাকল, পাতা এবং অপরিপক্ব ফল কলেরা, আমাশয় ও অন্যান্য পেটের পীড়া নিরাময়ে ভালো কাজ করে। ক্ষত বা ঘাঁতে থেঁতলানো অংশে পাতার প্রলেপ দিলে উপকার পাওয়া যায়। পেয়ারা পাতা চিবালে দাঁতের ব্যথা উপশম হয়। পেয়ারা পেকটিনের একটি অন্যতম উৎস। পেয়ারাতে প্রচুর পরিমাণে পেকটিন থাকায় জ্যাম, জেলি তৈরিতে অদ্বিতীয়। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পেয়ারা থেকে তৈরি হয় সুস্বাদু শরবত, আচার, আইসক্রিম প্রভৃতি। জাপানে পেয়ারার পাতা থেকে চা তৈরি করা হচ্ছে এবং তা ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। টাটকা অবস্থায় পরিপক্ব ফল থেকে সালাদ, পুডিং প্রভৃতি তৈরি করা যায়। রহিম (২০০৮) এর মতে, পেয়ারায় ৮০-৮৩% পানি, ২.৪৫% অম্ল, ৩.৫০-৪.৪৫% বিজারিত চিনি, ৩.৯৭-৫.২৩% অবিজারিত চিনি, ৯.৭৩% মোট দ্রবনীয় শুষ্ক পদার্থ, ০.৪৮% পটাশিয়াম, ২৬০ মি. গ্রাম/১০০ গ্রাম ভিটামিন সি. থাকে। মৌসুম, পরিপক্বতা ও জাতভেদে এর তারতম্য হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বাউ পেয়ারা ১-৯, কাজী, স্বরূপকাঠি, মুকুন্দপুরী, ইপসা, ইত্যাদি পেয়ারার চাষ হয়। তবে কাজী ও স্বরূপকাঠি পেয়ারা ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে এই কাজী ও স্বরূপকাঠি পেয়ারাসহ অন্যান্য জাত উইল্টিং’ বা ‘নেতিয়ে পড়া’ রোগ দ্বারা ভীষণভাবে আক্রান্ত হচ্ছে যার কার্যকরী তেমন কোন চিকিৎসা পদ্ধতি নাই। তাই একমাত্র উইল্ট প্রতিরোধী জাত দ্বারা অঙ্গজ উপায়ে জোড়কলমের মাধ্যমে ‘উইল্টিং’ বা ‘নেতিয়ে পড়া’ রোগ প্রতিরোধী গাছ তৈরি করে আমরা অধিক পেয়ারা উৎপাদন করতে পারি, যা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
উইল্ট (Wilt) রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রকৃতি : এই রোগটি ছত্রাক দ্বারা সংঘটিত হয়। রোগাক্রান্ত গাছের একটি ডগা প্রথমে শুকিয়ে যায়, এরপর একটি ডালের সমস্ত পাতা এবং ডগা উপর থেকে প্রথমে হলুদ হয়ে শুকিয়ে মারা যায়,আস্তে আস্তে গাছের একটি পাশ এবং ১০-১৫ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ গাছ ঢলে পড়ে। অম্লীয় মাটিতে এই রোগের আক্রমণ বেশি হতে দেখা যায়।
জোড় কলম কি? : সাধারণত যৌন ও অযৌন এই দুই পদ্ধতিতে গাছের বংশ বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। প্রথমটি বীজ এর মাধ্যমে এবং এতে মাতৃগাছের গুণাগুণ বজায় থাকে না। দ্বিতীয়টি অঙ্গজ উপায়ে এবং এই পদ্ধতিতে তৈরি করা গাছ মাতৃগাছের গুণাগুণ হুবহু বজায় রাখতে পারে এবং এতে রোগ প্রতিরোধী গাছ উদ্ভাবন সম্ভব। কারণ জোড় কলমের মাধ্যমে অনাকাক্সিক্ষত কিন্তু পরিবেশ সহনশীল এমন একটি চারাগাছ (রুটস্টক) এর উপরে কাক্সিক্ষত গাছের কাণ্ডের অংশ (সায়ন) জোড়া লাগানোর মাধ্যমে হুবহু মাতৃগাছের গুণাগুণ সম্পন্ন গাছ পাওয়া যায়, যা কাক্সিক্ষত ফলদানে সক্ষম। জোড় কলমের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে, যেমন-কনটাকট (সংস্পর্শ), ভিনিয়ার, ক্লেফট, ইত্যাদি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টারে গবেষণায় দেখা গেছে যে, পেয়ারায় সংস্পর্শ, ভিনিয়ার, ক্লেফট, সবরকম জোড় কলমেই উল্লেখযোগ্য সফলতা পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যে সংস্পর্শ জোড় কলমই সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি।
পেয়ারা গাছে জোড় কলম কেন করব? : পেয়ারা একটি অতি পরিচিত ফল হওয়া সত্ত্বেও আমরা এর উৎপাদনে খুব একটা বেশি যতœবান নই। বীজ থেকে উৎপাদিত চারা দ্বারাই সাধারণত আমরা যেন তেন ভাবে পেয়ারা চাষ করে থাকি। যার ফলে দিন দিন ফলের গুণগতমান কমে যাচ্ছে এবং নানা রকম রোগ জীবাণু দ্বারা ফল গাছ আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ‘উইল্টিং’ বা ‘নেতিয়ে পড়া’ রোগ দ্বারা বিভিন্ন জাতের পেয়ারা খুব বেশি আক্রান্ত হয়ে পড়েছে যা পেয়ারার মোট উৎপাদনের উপর একটি বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তাই জোড় কলমের মাধ্যমে ‘উইল্টিং’ প্রতিরোধী গাছ তৈরি করে পেয়ারার সফল উৎপাদন সম্ভব।
বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টারে, একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, পলি পেয়ারা, আঙ্গুর পেয়ারা ও স্ট্রবেরি পেয়ারার জাতের চারাকে আদিজোড় হিসাবে ব্যবহার করে পেয়ারার উইল্ট রোগ এড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে আঙ্গুর পেয়ারার বীজের চারা অনেক চিকন হয় বলে জোড় কলমের ক্ষেত্রে পলি পেয়ারা ও স্ট্রবেরি পেয়ারার বীজের চারাকে আদিজোড় হিসাবে ব্যবহার করা উত্তম। বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টারে অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, উইল্টিং সংবেধনশীল জাত কাজী ও স্বরূপকাঠি এবং প্রতিরোধি জাত পলি পেয়ারাতে উইল্টিং রোগের বাহক ঋঁংধৎরঁস ড়ীুংঢ়ড়ৎঁস দেয়া হয়। এতে দেখা যায় যে ঋঁংধৎরঁস ড়ীুংঢ়ড়ৎঁস এর কারণে কাজী
ও স্বরূপকাঠি আক্রন্ত হয় কিন্তু পলি পেয়ারা ঋঁংধৎরঁস ড়ীুংঢ়ড়ৎঁস সহ্য করতে পারে যা চিত্রে দেখানো হলো।
চিত্রে- ক. কাজী পেয়ারা খ. স্বরূপকাঠি পেয়ারা গ. পলি পেয়ারার উপর কাজী ও স্বরূপকাঠি পেয়ারা জোড় কলম এবং ঘ. পলি পেয়ারার মূলে উইল্টিং রোগের জন্য দায়ী ছত্রাক ঋঁংধৎরঁস ড়ীুংঢ়ড়ৎঁস প্রয়োগের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ক, খ, ও গ এর সকল ক্ষেত্রে ডান দিকের চারাটি পলি পেয়ারার চারা।
পেয়ারা গাছের বাকল-ছাল খুবই পাতলা এবং শুষ্ক যার ফলে ভিনিয়ার ও ক্লেফট জোড় কলমের ক্ষেত্রে জোড়া লাগার আগেই সায়ন শুকিয়ে মারা যেতে পারে এবং যে জন্য সফলতার হার কম। কিন্তু সংস্পর্শ জোড় কলমের ক্ষেত্রে যেহেতু সায়ন ভালোভাবে জোড়া লাগার পূর্ব পর্যন্ত মাতৃগাছের সাথেই থাকে সে কারণে সায়ন শুকিয়ে মারা যাওয়ার ভয় থাকে না এবং গ্রাফট সফলতার হার অনেক বেশি।
সংস্পর্শ জোড় কলম করার পদ্ধতি : উপযুক্ত সময় মে থেকে আগস্ট মাস। কারণ এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা এবং গাছের কোষের কার্যকারিতা বেশি থাকে।
স্টক তৈরি : পলি পেয়ারা, আঙ্গুর পেয়ারা ও স্ট্রবেরি পেয়ারার মধ্যে থেকে যে কোন একটির বীজ হতে চারা তৈরি করতে হবে যার উপর কাক্সিক্ষত অংশ জোড়া লাগানো সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে পরিণত গাছের ফল হতে সুস্থ ও সবল বীজ, চারা তৈরি করার জন্য ব্যবহার করতে হবে। বীজ সরাসরি পলিব্যাগে অথবা বীজ বেডে বপন করে চারা তৈরি করা যেতে পারে। ৯-১২ মাস বয়সের চারা আদিজোড় হিসাবে ব্যবহার করা ভালো তবে রোগজীবাণু মুক্ত সবল ও সতেজ চারা নির্বাচন করতে হবে।
সায়ন নির্বাচন : উৎকৃষ্ট ও কাক্সিক্ষত গাছ হতে আদিজোড় এর সম ব্যাস বা আকৃতির পরিণত (সেমি হার্ড) সায়ন বা ডাল নির্বাচন করতে হবে। সায়ন পেনসিলের মতো হলে ভালো হয়। সায়নের বয়স অবশ্যই পরিণত হতে হবে। সায়নের জন্য নির্বাচিত ডালের পাতাগুলো গাঢ় সবুজ হতে হবে। চলতি মৌসুমের ডাল অর্থাৎ বর্ধিঞ্চু ডাল হতে হবে। নতুন গজানো অল্প বয়স্ক সবুজাভ কুশি সায়ন হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। সংস্পর্শ জোড় কলমের জন্য নির্বাচিত সায়ন শাখাটি লম্বায় ১২-১৮ ইঞ্চি হতে হবে। সায়ন অবশ্যই রোগবালাই ও পোকামাকড় মুক্ত হতে হবে।
সংস্পর্শ জোড় লাগানোর পদ্ধতি : কাক্সিক্ষত গাছে উপযুক্ত সায়ন ডাল নির্বাচন করে স্টক গাছকে তার কাছাকাছি আনতে হবে।
এরপর স্টক গাছে এবং কাক্সিক্ষত সায়ন ডালের ৪-৫ সেমি. স্থানের বাকল কিছু কাঠসহ উঠিয়ে উভয়কে যথাসম্ভব নিকটতম সংস্পর্শে আনতে হবে যাতে সায়ন এবং আদিজোড়ের কর্তিত অংশের বাকল পরস্পর মিলে যায়।
এরপর পলিথিন ফিতা দিয়ে জোড়া লাগানো অংশ এমনভাবে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে, যাতে বৃষ্টির পানি ওই অংশে প্রবেশ করতে না পারে। (চিত্র-ক-চ)
পরবর্তী পরিচর্যা : আদিজোড় (স্টক চারা) এর গোড়ায় পলিব্যাগে প্রয়োজন অনুসারে পানি দিয়ে মাটির রস ঠিক রাখতে হবে; ভালোভাবে জোড়া লাগার পর আদিজোড়ের উপরের অংশ কেটে ফেলতে হবে; ৩-৪ মাস পর সায়নের নিচের অংশ ২ বারে কাটতে হবে অর্থাৎ অর্ধেক অংশ কাটার এক সপ্তাহ পর বাকি অর্ধেক কাটতে হবে; গ্রাফট কে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে; আদিজোড় (স্টক চারা) থেকে বের হওয়া অনাকাক্সিক্ষত কুঁড়ি দেখামাত্র ভেঙে দিতে হবে; জোড়ার নিচের সায়ন অংশ থেকে বের হওয়া কুঁড়িও দেখামাত্র ভেঙে ফেলতে হবে।
এছাড়া ভিনিয়ার কলমের মাধ্যমে (এ কলম তৈরি করার সময় আদিজোড়ের একপাশে ও উপ-জোড়-কে ঠ-এর মতো করে বাকলসহ পাতলা কাঠ তুলে সংযুক্ত করে এ কলম করা হয়) এবং ক্লেফট গ্রাফটিং এর মাধ্যমেও (এক্ষেত্রে আদি জোড়-কে লম্বা-লম্বিভাবে ৫-৭.৫ সেমি. গভীর করে ফাটায়ে উপজোড়কেও উভয় পাশে তীর্যকভাবে কাঠ দিয়ে আদি জোড়ের মধ্যে প্রবিষ্ঠ করে সংযুক্ত করে এ কলম করা হয়) উইল্ট প্রতিরোধী পেয়ারার গ্রাফট উৎপাদন করা যেতে পারে।
প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম* ড. মো. শামছুল আলম মিঠু**
*উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বা.কৃ.বি এবং পরিচালক, বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বা.কৃ.বি., ময়মনসিংহ মোবাইল : ০১৭১১৮৫৪৪৭১, ই-মেইল : সধৎধযরস১৯৫৬@নধঁ.বফঁ.নফ **সিনিয়র রিসার্চ এসোসিয়েট, বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বা.কৃ.বি. মোবাইল : ০১৭১১১২৪৭২২ ই-মেইল: marahim1956@bau.edu.bd